Logo

রুকইয়াহ: পরিচয়, প্রকার, প্রয়োজনীয়তা, বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং সম্পর্কিত বিষয়সমূহ

ফাতিহা ফালাক ডেস্ক
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২: ৪২
নামাজ মুসলিম জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

রুকইয়াহ শারইয়্যাহ হলো শরিয়াহসম্মত ঝাড়ফুঁক, যা কোরআনের নির্দিষ্ট আয়াত এবং হাদিসে বর্ণিত দোয়ার মাধ্যমে জ্বিন, জাদু, বদনজর এবং শারীরিক-মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি আল্লাহর কালামের শক্তির মাধ্যমে মানুষকে আধ্যাত্মিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ করার একটি ইসলামি পদ্ধতি। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে রুকইয়াহ করেছেন এবং সাহাবিদের শিখিয়েছেন। বর্তমান সময়ে জ্বিন, জাদু, বদনজর এবং মানসিক সমস্যার প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় রুকইয়াহর প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। এই নিবন্ধে রুকইয়াহর পরিচয়, প্রকার, প্রয়োজনীয়তা, বর্তমান প্রেক্ষাপট, বৈধ-অবৈধ তাবিজ, জিন, বদনজর, ওয়াসওয়াসা, মানসিক ব্যাধি এবং সম্পর্কিত বিষয়গুলো সহজ ভাষায় আলোচনা করা হলো।

রুকইয়াহর পরিচয়

রুকইয়াহ শব্দটি আরবি ‘রুকিয়া’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ঝাড়ফুঁক বা দোয়ার মাধ্যমে চিকিৎসা। এটি কোরআনের আয়াত, হাদিসে বর্ণিত দোয়া এবং আল্লাহর নামের মাধ্যমে রোগ নিরাময়ের একটি পদ্ধতি। কোরআনে বলা হয়েছে, “আমরা কোরআনে এমন কিছু নাযিল করি, যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত।” (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৮২)। রাসুল (সা.) বলেছেন, “রুকইয়াহ করায় কোনো সমস্যা নেই, যদি তাতে শিরক না থাকে।” (মুসলিম, হাদিস : ২২০০)। শরিয়াহসম্মত রুকইয়াহতে কেবল কোরআন, হাদিস এবং আল্লাহর নাম ব্যবহৃত হয়।

রুকইয়াহর প্রকার

রুকইয়াহ প্রধানত দুই প্রকার:

  1. শারই রুকইয়াহ: এটি শরিয়াহসম্মত, যা কোরআনের আয়াত এবং হাদিসে বর্ণিত দোয়ার মাধ্যমে করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, সুরা ইখলাস, ফালাক, নাস ইত্যাদি।
  2. অশারই রুকইয়াহ: এটি শরিয়াহবহির্ভূত, যেমন তাবিজ, মন্ত্র বা জিনের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে চিকিৎসা। এটি শিরকের আওতায় পড়ে এবং নিষিদ্ধ।

রুকইয়াহর প্রয়োজনীয়তা

রুকইয়াহর প্রয়োজনীয়তা বর্তমান সময়ে অপরিসীম। নিম্নলিখিত কারণে রুকইয়াহ গুরুত্বপূর্ণ:

  1. জ্বিন ও জাদুর প্রভাব: আধুনিক যুগে জাদু ও জ্বিনের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। রুকইয়াহ এগুলো থেকে মুক্তির জন্য কার্যকর।
  2. বদনজর: বদনজর একটি বাস্তব সমস্যা, যা মানুষের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করে। রুকইয়াহ এর থেকে সুরক্ষা দেয়।
  3. মানসিক শান্তি: ওয়াসওয়াসা ও মানসিক অস্থিরতা দূর করতে রুকইয়াহ অতুলনীয়।
  4. শারীরিক রোগ: কোরআনের আয়াত শারীরিক রোগের জন্যও শিফা প্রদান করে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে রুকইয়াহ

বর্তমান সময়ে মানুষের জীবনযাত্রা জটিল হয়ে পড়েছে। মানসিক চাপ, উদ্বেগ, এবং আধ্যাত্মিক সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্বিন, জাদু এবং বদনজরের প্রভাবও অনেকের জীবনে প্রভাব ফেলছে। এমন পরিস্থিতিতে রুকইয়াহ মানুষের জন্য একটি আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক সমাধান। আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি রুকইয়াহ শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, শরিয়াহসম্মত রুকইয়াহর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া এবং অশারই পদ্ধতি থেকে দূরে থাকা জরুরি।

বৈধ ও অবৈধ তাবিজ

  • বৈধ তাবিজ: শুধু কোরআনের আয়াত বা হাদিসে বর্ণিত দোয়া লিখিত তাবিজ বৈধ, যদি তা শিরকমুক্ত হয়। রাসুল (সা.) তাঁর সাহাবিদের জন্য কোরআনের আয়াত লিখে তাবিজ হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। (বুখারি, হাদিস : ৫৭৩৫)।
  • অবৈধ তাবিজ: অশারই তাবিজে অর্থহীন শব্দ, সংখ্যা, চিহ্ন বা জিনের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে লেখা থাকে। এগুলো শিরক এবং নিষিদ্ধ। রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তাবিজ ব্যবহার করে, আল্লাহ তার ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করেন।” (আহমদ, হাদিস : ১৬৯৬৯)।

প্রচলিত কুসংস্কার

বর্তমানে কিছু কুসংস্কার রুকইয়াহর নামে প্রচলিত আছে:

  1. সংখ্যা পদ্ধতির তাবিজ: সংখ্যা বা চিহ্ন দিয়ে তৈরি তাবিজ শিরকের আওতায় পড়ে।
  2. রশি বা গণনা পদ্ধতি: রশি বেঁধে বা নির্দিষ্ট সংখ্যক গিঁট দিয়ে চিকিৎসা শরিয়াহসম্মত নয়।
  3. জিন হাজির করা: জিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা তাদের দিয়ে চিকিৎসা শিরক এবং নিষিদ্ধ।

জিন সম্পর্কিত মৌলিক কথা

জিন হলো আল্লাহর সৃষ্ট প্রাণী, যারা অদৃশ্য এবং আগুন থেকে সৃষ্ট। (সুরা আর-রহমান, আয়াত ১৫)। কোরআনে জিনের কথা উল্লেখ আছে এবং তাদের মধ্যে ভালো ও মন্দ উভয়ই রয়েছে। মন্দ জিন মানুষের ক্ষতি করতে পারে, যেমন জাদু, বদনজর বা ওয়াসওয়াসার মাধ্যমে। রুকইয়াহ এই মন্দ জিনের প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য কার্যকর।

জিনের আসর ও মাসসুস শয়তান

জিনের আসর বা মাসসুস শয়তান বলতে এমন অবস্থাকে বোঝায়, যখন কোনো জিন মানুষের শরীরে প্রভাব বিস্তার করে। এটি হতে পারে জাদু, বদনজর বা শয়তানের প্ররোচনার মাধ্যমে।

  • জিনের আসরের প্রকারভেদ:
  1. পূর্ণ আসর: জিন মানুষের শরীরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়।
  2. আংশিক আসর: জিন মাঝে মাঝে প্রভাব বিস্তার করে।
  3. বাহ্যিক প্রভাব: শরীরে প্রবেশ না করে বাইরে থেকে ক্ষতি করে।
  • লক্ষণ: অস্বাভাবিক আচরণ, দুঃস্বপ্ন, মাথাব্যথা, শরীরে ব্যথা, অস্থিরতা, ওয়াসওয়াসা।
  • চিকিৎসা:
  1. কোরআনের আয়াত পড়া, যেমন সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, সুরা ইখলাস, ফালাক, নাস।
  2. হাদিসে বর্ণিত দোয়া পড়া।
  3. জায়তুন তেল বা পানিতে কোরআন পড়ে ব্যবহার।

বদনজর: বাস্তবতা, লক্ষণ ও চিকিৎসা

বদনজর একটি বাস্তব সমস্যা, যা কোরআনে উল্লেখিত। (সুরা কালাম, আয়াত ৫১-৫২)। এটি হিংসা বা প্রশংসার মাধ্যমে ক্ষতি করে।

  • লক্ষণ: অকারণ ক্লান্তি, মাথাব্যথা, রোগ, মানসিক অস্থিরতা।
  • চিকিৎসা:
  1. সুরা ফালাক ও নাস পড়ে শরীরে ফুঁ দেওয়া।
  2. রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে বদনজর দেয়, তাকে বলো গোসল করে পানি সংগ্রহ করতে। সেই পানি রোগীর ওপর ঢালতে হবে।” (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৮০)।

ওয়াসওয়াসা: বাস্তবতা, লক্ষণ ও করণীয়

ওয়াসওয়াসা হলো শয়তানের ফিসফিসানি, যা মানুষকে সন্দেহ, ভয় ও অস্থিরতায় ফেলে।

  • লক্ষণ: ধর্মীয় কাজে সন্দেহ, অকারণ ভয়, নেতিবাচক চিন্তা।
  • করণীয়:
  1. সুরা নাস পড়া।
  2. “আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম” বলা।
  3. আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা।

বাতাস লাগা, বোবায় ধরা, দুঃস্বপ্ন

  • বাতাস লাগা: জ্বিন বা শয়তানের প্রভাবে হঠাৎ অস্থিরতা বা ভয়।
  • বোবায় ধরা: জ্বিনের প্রভাবে কথা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
  • দুঃস্বপ্ন: ভয়ঙ্কর স্বপ্ন জ্বিন বা শয়তানের প্রভাবে হতে পারে।
  • চিকিৎসা: সুরা ফালাক, নাস, আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দেওয়া এবং ঘুমানোর আগে দোয়া পড়া।

মানসিক ব্যাধি

মানসিক ব্যাধি জ্বিন, জাদু বা শয়তানের প্রভাবে হতে পারে।

  • উল্লেখযোগ্য মানসিক রোগ: উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, ওয়াসওয়াসা, অকারণ ভয়।
  • চিকিৎসা: রুকইয়াহ, কোরআন তিলাওয়াত, ধর্মীয় আমল এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ।

রুকইয়ার আগে যা জানতে হবে

  1. প্রকৃত রাকীর গুণাবলি: রাকী হতে হবে শরিয়াহ জ্ঞানসম্পন্ন, আল্লাহভীরু এবং শিরকমুক্ত।
  2. রুকইয়াহ সাপ্লিমেন্ট: জায়তুন তেল, মধু, কালোজিরা, কোরআন পড়া পানি।
  3. প্রস্তুতি ও শর্ত:
    • পবিত্রতা (ওযু)।
    • আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা।
    • শিরকমুক্ত নিয়ত।
  1. সেলফ রুকইয়াহর পূর্বে করণীয়: নিয়মিত নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া পড়া।

মাসসুস শয়তান, সিহর, বদনজর ও ওয়াসওয়াসার চিকিৎসা

  • মাসসুস শয়তান: সুরা বাকারা, আয়াতুল কুরসি, সুরা ফালাক, নাস পড়া।
  • সিহর (জাদু): সুরা আরাফ (১১৭-১২২), ইউনুস (৮১-৮২), ত্ব-হা (৬৫-৬৯) পড়ে ফুঁ দেওয়া।
  • বদনজর: সুরা ফালাক, নাস এবং বদনজর দেওয়া ব্যক্তির গোসলের পানি ব্যবহার।
  • ওয়াসওয়াসা: সুরা নাস, দোয়া এবং আল্লাহর ওপর ভরসা।

৭ দিনের ডিটক্স রুকইয়াহ

৭ দিনের ডিটক্স রুকইয়াহ হলো নিয়মিত কোরআন পড়া, দোয়া এবং গোসলের মাধ্যমে শরীর ও মনকে শুদ্ধ করা।

  • পদ্ধতি:
  1. প্রতিদিন সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, সুরা ইখলাস, ফালাক, নাস ৭ বার পড়া।
  2. পানিতে ফুঁ দিয়ে পান করা বা গোসল করা।
  3. জায়তুন তেলে পড়ে শরীরে মাখা।
  4. নিয়মিত নামাজ ও জিকির।

বাচ্চাদের রুকইয়াহ

বাচ্চাদের জন্য রুকইয়াহ সহজ এবং শরিয়াহসম্মত হতে হবে:

  1. সুরা ফালাক, নাস, আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দেওয়া।
  2. মধু বা পানিতে ফুঁ দিয়ে খাওয়ানো।
  3. রাতে ঘুমানোর আগে দোয়া পড়া।

রুকইয়ার প্রসিদ্ধ আয়াত ও দোয়া

  1. সুরা ফাতিহা (১:১-৭): প্রতিটি রোগের শিফা।
  2. আয়াতুল কুরসি (২:২৫৫): শয়তান থেকে সুরক্ষা।
  3. সুরা ইখলাস, ফালাক, নাস: জ্বিন, জাদু ও বদনজর থেকে মুক্তি।
  4. দোয়া: “আল্লাহুম্মা রব্বান নাস, আজহিবিল বাস, ইশফি আন্তাশ শাফি...” (বুখারি, হাদিস : ৫৭৪৩)।

উপসংহার

রুকইয়াহ শারইয়্যাহ হলো কোরআন ও হাদিসের আলোকে আধ্যাত্মিক ও শারীরিক চিকিৎসার একটি শক্তিশালী পদ্ধতি। এটি জ্বিন, জাদু, বদনজর, ওয়াসওয়াসা এবং মানসিক ব্যাধি থেকে মুক্তি দেয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানুষের আধ্যাত্মিক ও মানসিক সমস্যা বৃদ্ধির কারণে রুকইয়াহর গুরুত্ব অপরিসীম। তবে, শরিয়াহসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং শিরক থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত জরুরি। খাঁটি নিয়ত ও আল্লাহর ওপর ভরসার মাধ্যমে রুকইয়াহ করলে আল্লাহর রহমতে শিফা ও নিরাপত্তা লাভ করা সম্ভব।

বিষয়: